বাজেট সহায়তা এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় বাংলাদেশকে সাড়ে চার বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ দিতে সম্মত হয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটির ঢাকা সফররত মিশন বুধবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার এবং আইএমএফ কর্মকর্তারা ঋণের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন। মিশনটি বাংলাদেশের ঋণের বিষয়ে একটি রিপোর্ট তৈরি করবে এবং ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে আইএমএফের নির্বাহী পর্ষদে ঋণ অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় আশা করছে, আগামী ফেব্রুয়ারিতে ঋণের প্রথম কিস্তি ছাড় হবে। এ ঋণ বিদেশি মুদ্রার মজুত বা রিজার্ভ সুরক্ষায় সহায়তা করবে বলে আশা করছে বাংলাদেশ সরকার এবং আইএমএফ।
বিবৃতিতে বলা হয়, আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) এবং এক্সটেন্ডেড ফান্ড ফ্যাসিলিটি (ইএফএফ) থেকে ৩২০ কোটি ডলার এবং জলবায়ু বিষয়ক রেজিলিয়েন্স অ্যান্ড সাসটেইনিবিলিটি ফ্যাসিলিটি (আরএসএফ) থেকে ১৩০ কোটি ডলার ঋণ দেওয়ার বিষয়ে কর্মকর্তা পর্যায়ে তাঁরা একমত হয়েছেন। এ ঋণের উদ্দেশ্য বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা এবং অসুবিধাগ্রস্ত মানুষকে সুরক্ষা দিয়ে শক্তিশালী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সবুজ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে সহায়তা করা। ৪২ মাস ধরে এ ঋণ দেওয়ার কার্যক্রম চলবে। এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আইএমএফের ঋণের রেয়াতকাল থাকবে পাঁচ বছর এবং এরপর ১০ বছরের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। সুদের হার হতে পারে গড়ে ২ দশমিক ২ শতাংশ।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, সরকারের এসব পদক্ষেপ বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে, অর্থনীতিতে ঝুঁকির মাত্রা কমাবে এবং অতি প্রয়োজনীয় সামাজিক উন্নয়ন এবং জলবায়ু ব্যয় মেটানোর মাধ্যমে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
ঢাকা সফর শেষে আইএমএফ মিশন বিবৃতি দেওয়ার পাশাপাশি গতকাল অর্থ মন্ত্রণালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। গত জুলাই মাসে আইএমএফের কাছে ঋণ চেয়ে আনুষ্ঠানিক চিঠি দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এই প্রক্রিয়ার এ পর্যন্ত শেষ ধাপে দুই সপ্তাহ ধরে ঢাকা সফরে রয়েছে আইএমএফ মিশন। গত ২৬ অক্টোবর ঢাকা সফরে আসেন তাঁরা। সরকারের বিভিন্ন সংস্থা ও বিভাগের সঙ্গে একাধিকবার করে মোট ৩০টি বৈঠক করেন তাঁরা। ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন সংস্থার এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের কর্মকর্তা রাহুল আনন্দ।
সংবাদ সম্মেলনে মিশনপ্রধান বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে নীতিসহায়তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁরা ঋণ দিতে সম্মত। আইএমএফ এমন এক সময় ঋণ দিচ্ছে যখন বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এসেছে। এ নির্বাচন এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আইএমএফ উদ্বিগ্ন কিনা- একজন সাংবাদিকের এমন প্রশ্নের জবাবে আইএমএফ মিশনপ্রধান বলেন, এ দেশের রাজনীতি নিয়ে আইএমএফের কোনো উদ্বেগ নেই। বাংলাদেশের সঙ্গে আইএমএফের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ অংশীদারত্ব রয়েছে।
এ মুহূর্তে বাংলাদেশের রিজার্ভ কতটুকু উদ্বেগের এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি রাহুল আনন্দ। তিনি বলেন, সাড়ে তিন মাসের আমদানি দায় মেটানোর মতো রিজার্ভ বাংলাদেশের হাতে রয়েছে। কতটুকু উদ্বেগের তা নির্ভর করছে সার্বিক পরিস্থিতির ওপর। বৈদেশিক উৎস থেকে কতটুকু সহায়তা পাওয়া যাবে তাও একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যদিও বাংলাদেশের জিডিপি অনুপাতে বৈদেশিক ঋণ এখনও স্বস্তিদায়ক সীমার মধ্যে রয়েছে। তবে তাঁরা মনে করেন, রিজার্ভ বাড়ানো প্রয়োজন। বিশ্ব অর্থনীতির সংকট কবে নাগাদ কাটবে কেউ জানে না। রিজার্ভ বাড়াতে আমদানি বিকল্প পণ্য উৎপাদন, রপ্তানি বাড়ানো ও বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর দিকে জোর দেওয়া উচিত।
কোন কারণে রিজার্ভ কমল- এমন প্রশ্নের জবাবে আইএমএফের মিশনপ্রধান বলেন, করোনাকালে ৪৮ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উঠেছিল রিজার্ভ। ওই সময় যাতায়াত সংকটে হুন্ডির সুযোগ কম থাকায় রেমিট্যান্সে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ছিল। রপ্তানি খাতও দ্রুত ঘুরে দাঁড়ায়। অন্যদিকে আমদানি কম ছিল। এ কারণে রিজার্ভ বেশি ছিল। গত অর্থবছর রপ্তানি বেড়েছে ১৩ শতাংশ হারে- যা যথেষ্ট ছিল না। এসব মিলিয়ে রিজার্ভ কমেছে। তবে রিজার্ভ নিরাপদ রাখা দরকার। বাংলাদেশের রিজার্ভের যে পরিসংখ্যান প্রকাশ করা হয়, তা প্রকৃত নয়। রিজার্ভের যে অংশ বিভিন্ন তহবিলে জোগান দেওয়া হয়েছে, তা বাদ দিয়ে প্রকৃত পরিসংখ্যান প্রকাশের বিষয়ে তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংককে পরামর্শ দিয়েছেন।
মূল্যস্ম্ফীতি-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের মন্তব্যে রাহুল আনন্দ বলেন, ‘অক্টোবরে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমে এলেও এ হার এখনও অনেক বেশি। সারাবিশ্বেই পণ্যমূল্য বেড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বাংলাদেশের প্রায় সব পণ্যই আমদানিনির্ভর। এ কারণে দেশেও মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। এ ছাড়া ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমার কারণেও মূল্যস্ম্ফীতির চাপ বাড়ছে।’ ভর্তুকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘কিছু ভর্তুকির প্রয়োজন রয়েছে। নাজুক অবস্থায় থাকা দরিদ্র মানুষের সামাজিক সুরক্ষা সহায়তার প্রয়োজন রয়েছে। তবে ঢালাওভাবে সবার জন্য ভর্তুকির প্রয়োজন নেই।’
বর্তমান পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারকে আইএমএফের পক্ষ থেকে কী পরামর্শ দেওয়া হয়েছে- এ প্রশ্নের জবাবে মিশনপ্রধান বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতি এ মুহূর্তে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে। বাংলাদেশও চাপে আছে। এসব বিবেচনায় রাজস্ব কাঠামোতে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারের কথা বলা হয়েছে। কর জিডিপি অনুপাত বাড়ানো, মুদ্রানীতি ও বাণিজ্যনীতি আধুনিকায়নের কথাও বলা হয়েছে। এ ছাড়া নির্দিষ্ট রপ্তানি পণ্য এবং বাজারনির্ভরতা থেকে বহুমুখীকরণের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। জলবায়ুর অভিঘাত প্রশমনে ব্যবস্থা থাকা দরকার। এ বিষয়ে বাংলাদেশ বেশ আন্তরিক।’ সূত্র: সমকাল