ময়মনসিংহে ই-কমার্সে রয়েছে অপার সম্ভাবনা

digitalsomoy

মাঠ পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের কাজের প্রতি উৎসাহিত, অনুপ্রাণিত এবং ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রির সমস্যা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে তাদের সামনে তুলে ধরতে ময়মনসিংহে হয়ে গেলো এক আলোচনা সভা।শুক্রবার (১৯ মার্চ) ময়মনসিংহ শহরের গ্রীন পার্ক রেস্টুরেন্টে ‘ই-কমার্সের সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শিরোনামে আলোচনা সভার আয়োজন করে ময়মনসিংহের কয়েকজন দেশি পণ্যের ই-কমার্স উদ্যোক্তা ও নিউজ পোর্টাল টেকজুম ডটটিভি।

আলোচনা সভা শুরু হয় সকাল ১১ টায়। স্বগাত বক্তব্য দেন খাতুনে জান্নাত আশা এবং আলোচনা সভার উদ্দেশ্য উপস্থাপন করেন ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজিব আহমেদ।  

আলোচনা সভায় আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহ সিটি কার্পোরেশনের মেয়র ইকরামুল হক টিটু, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহের বিভাগীয় প্রধান ও প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম, বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিনা), ময়মনসিংহের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মো. কামরুজ্জামান, ই-ক্যাবের প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট রাজিব আহমেদ,  টেকজুম ডটটিভির সম্পাদক ওয়াশিকুর রহমান শাহিন, টেকজুমের শেরপুর প্রতিনিধি মো. দেলোয়ার হোসেন, টেকজুমের ময়মনসিংহ বিভাগীয় প্রতিনিধি ও আফাফ ক্রিয়েশনের স্বত্বাধিকারী আরিফা খাতুন এবং টেকজুমের ময়মনসিংহ জেলা প্রতিনিধি ও পিয়সীর স্বত্বাধিকারী খাতুনে জান্নাত আশা।

ইকরামুল হক টিটু বলেন, আগের তুনলনায় ই-কমার্স সেক্টরে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। একযুগ আগেও ময়মনসিংহে নারী উদ্যোক্তা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব ছিল। ই-কমার্সের কারণে এখন চিত্র পাল্টেছে। ই-কমার্স না থাকলে করোনা কালীন ঘরে বসে সেবা পাওয়া দুষ্কর ছিল। অনেকের চাকরি বা ব্যবসা বন্ধ হওয়ায় পুজিঁ নষ্ট করে চলতে হতো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর  তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় মহোদয়ের পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী বার বছর পূর্বে প্রযুক্তিনির্ভর আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার নির্বচনী ইশতেহার ঘোষণা করেছিলেন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন করেছেন। এরফলে ই-কমার্সসহ অন্যান্য আধুনিক সেবা গ্রহণের সুযোগ পাচ্ছি। ই-কমার্স উদ্যোক্তারা নিজের অবস্থান মেলে ধরার পাশাপাশি দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেগবান করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। গোল টেবিল আলোচনার ফলে ময়মনসিংহের ই-কমার্সের চ্যালেঞ্জগুলো জেনে সঠিক পরিকল্পনা মাফিক কাজ করে এগিয়ে নেওয়া যাবে। এতে ময়মনসিংহের ই-কমার্স দ্রুত বড় হওয়ার ব্যাপক সম্ভবানা রয়েছে। হুজুগে ই-কমার্স উদ্যোক্তা না হওয়ার পরামর্শ দেন টিটু।

ডা. মোহাম্মদ শহিদুল ইসলাম বলেন, নারীরা আজকের দিনে আর পিছিয়ে নেই। প্রধানমন্ত্রী নারীদের এগিয়ে যেতে প্রতিনিয়ত উৎসাহ প্রদান করছেন। ই-কমার্সে ক্যান্সার প্রতিরোধক শুকনো পাটশাক, আয়রণ সমৃদ্ধ বিনা ধান, নকশীকাঁথা, মাশরুমসহ অন্যান্য পণ্যের সম্ভাব্য বাজার তুলে ধরেন। এসব পণ্যের ব্র্যান্ডিং গুরুত্ব ও সহজলভ্যতার সম্ভাবনাও তুলে ধরেন। আস্থা অর্জনে সিগনেচার পণ্যের গুরুত্ব উল্লেখ করেছেন। ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের জন্য বিনামূল্যে প্রশিক্ষণ, বীজ বিতরণসহ অন্যান্য সুবিধার কথা উল্লেখ করেন। অর্গানিক কৃষি পণ্যের বাজার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সঠিক প্রচার আর সিরিয়াসভাবে উদ্যোক্তারা লেগে থাকলে দেশের কৃষি মার্কেটে ময়মনসিংহের ই-কমার্স উদ্যোক্তারা এগিয়ে থাকবে।

ডা. মো. কামরুজ্জামান, প্রধানমন্ত্রীর বাণী, ‘প্রতিটা গ্রাম হবে শহর’ বাস্তবায়ন করতে ই-কমার্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। ই-কমার্সে ভোগান্তিহীন কেনাকাটা করা যায়। তাই বর্তমানে মানুষ বাহিরে গিয়ে কেনাকাটাকে ভোগান্তি আর সময় অপচয় মনে করে। এটি ই-কমার্সের জন্য বিশাল সম্ভাবনা। অর্গানিক কৃষি বাজারের আকার এবং সম্ভাবনাও তুলে ধরেছেন বৈঠকে। তিনি উদ্যোক্তাদের তিনটি বিষয়ে সতর্ক করেন, সময় মূল্য ও পরিদর্শন।

রাজিব আহমেদ বলেন, সেই ২০১৪ সাল থেকে বলে আসছি যে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছাতে হলে ই-কমার্সকে এগিয়ে নিতে হবে। কৃষি সমৃদ্ধ ময়মনসিংহ বিভাগে অনেক আগে থেকেই ভালো ভালো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাই এই অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক স্টার্টআপ তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রান্তিক পর্যায়ে পণ্য ডেলিভারি সমস্যা নিরসনে বড় কুরিয়ার সার্ভিসগুলো চেষ্টা  করে যাচ্ছে। এবছরের মধ্যে প্রতিটি গ্রামে না হোক প্রতিটি ইউনিয়নে ই-কমার্সকে নিয়ে যেতে হবে। কৃষি পণ্য, হোটেল, দর্শনীয় স্থানসহ সম্ভাব্য খাতগুলো এগিয়ে নিতে উদ্যোক্তারা মিলেমিশে অন্তত একটি রিপোর্ট করার চেষ্টা করতে হবে।

ওয়াশিকুর রহমান শাহিন বলেন, বিভাগীয় ই-কমার্সকে এগিয়ে নিতে উদ্যোক্তাদের ঐক্যবদ্ধতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ডেলিভারির মতো গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাও সমাধান করা সম্ভব হবে যদি উদ্যোক্তারা ঐক্যবদ্ধ থাকেন। মানুষে বহু রকমের চাহিদা পূরণ করতে ভিন্ন ভিন্ন প্রোডাক্ট ও সার্ভিসে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, আনন্দমোহন কলেজসহ অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে ময়মনসিংহে। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে প্রতিবছর হাজার হাজার পোস্ট গ্রাজুয়েট বের হয়ে চাকরির বাজারে প্রবেশ করে। তাদেরকে ই-কমার্সের সাথে সম্পৃক্ত করতে পারলে বেকারত্ব হ্রাস পাবে। এছাড়াও ময়মনসিংহে প্রায় সোয়া কোটি মানুষের বসবাস। এখন উপযুক্ত সময় তাদেরকে ই-কমার্সে উদ্বুদ্ধ করার। ঢাকা থেকে ময়মনসিংহের দূরত্ব কম হওয়ায় জেলায় উৎপাদিত পাট পণ্য, মাছ, মন্ডাসহ কৃষি পণ্য সারাদেশে দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ময়মনসিংহের ই-কমার্সকে এগিয়ে নিতে উদ্যোক্তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। পণ্যের কনটেন্ট বাড়াতে হবে এবং আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে। বিনা, সিটি কার্পোরেশন, চেম্বার অব কমার্সসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর আগ্রহ ময়মনসিংহের ই-কমার্সের প্রেরণা। বকৃষি থাকায় কৃষি ভিত্তিক স্টার্টআপ ও বড় বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান গড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

খাতুনে জান্নাত আশা বলেন, ময়মনসিংহের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠায় অপার সম্ভাবনা রয়েছে। ‘শিক্ষা নগরী’ হিসেবে পরিচিত ময়মনসিংহের ই-কমার্স সেক্টরে শিক্ষিত লোকদের এগিয়ে আসার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষিত উদ্যোক্তা তৈরির সম্ভাবনা রয়েছে। যারা ভালো মানের কন্টেন্ট তৈরি করে তারা অঞ্চলভিত্তিক পণ্যগুলোকে উঠিয়ে আনতে পারে। ময়মনসিংহে কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট থাকায় এবং এখানের গবেষকরা উদ্যোক্তাদের গবেষণায় সাহায্য করবে। এরফলে হারিয়ে যাওয়া কৃষিপণ্যগুলো পুনরুদ্ধার এবং নতুন পণ্য প্রচার প্রসার হবে।  ই-কমার্সে মৃৎশিল্পেও ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। ডেলিভারি সমস্যার সুষ্ঠু সমাধান প্রত্যাশা করেন।

ই-কমার্স উদ্যোক্তাদের মধ্যে আলোচক ছিলেন মাটির ফুল অর্গানিকের  স্বত্বাধিকারী রোকসানা আক্তার, ৭ ঋতুর স্বত্বাধিকারী  শামিমা নাসরিন ঋতু, সারমায়া ফ্যাশন হাউজের  স্বত্বাধিকারী ফাতেমা-তুজ-জোহুরা, মা ও মেয়ের বুটিকের  স্বত্বাধিকারী ফারজিনা আক্তার রুমা, দোলনচাঁপার  স্বত্বাধিকারী ফাতেমা খাতুন তিথি, ইপ্পি শপিংয়ের  স্বত্বাধিকারী  রোখসানা আক্তার পপি এবং কুয়াশা হস্তশিল্প জামালপুরের স্বত্বাধিকারী কুয়াশা কামরুন্নাহার। 

ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় প্রচুর আখ উৎপাদন হয়। ই-কমার্সে হাতে তৈরি ব্রাউন চিনির রয়েছে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান রোকসানা আক্তার।

শামিমা নাসরিন ঋতু বলেন, মায়মনসিংহে বিপুল পরিমাণ পাট উৎপাদন হয়। পাটের ফাইবার থেকে পোশাক, পাটকাঠি থেকে পারটেক্স বোর্ড,  চারকোল, ঘর সাজানোর সৌখিন সামগ্রী, পাটের চা ইত্যাদি উৎপাদন হয়। ই-কমার্সের মাধ্যমে এসবের প্রচর প্রসার বাড়ানো সম্ভব। পাটজাত পণ্যের কাঁচামাল সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাত করে ক্রেতার কাছে পৌঁছাতে মোটামুটি বিনিয়োগ লাগে। অর্থ জোগার করা উদ্যোক্তাদের জন্য একটু কঠিন হয়ে উঠে।

কুরিয়ার জটিলতা ও ব্যয় দেশের ই-কমার্স প্রসারে উল্লেখযোগ্য বাধা। কুরিয়ার সেবা আরও দ্রুত ও খরচ কমাতে পারলে দ্রুত বড় হবে ই-কমার্স সেক্টর বলে মন্তব্য করেন ফাতেমা-তুজ-জোহুরা।

ফারজিনা আক্তার রুমা বলেন, নতুন সেক্টরের সাথে কাস্টমারদের খাপ খাওয়াতে উদ্যোক্তাদের দক্ষতা অর্জন করতে হবে এবং নিয়মিত আপডেট হতে হবে। এছাড়াও নিয়মিত কাস্টমার এনালাইসিস করতে হবে তাদের চাহিদা বুঝার জন্য।

ফাতেমা খাতুন তিথি বলেন, ই-কমার্স সেক্টর নতুন হওয়ায় অন্যের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে সিজনাল উদ্যোক্তার সৃষ্টি হয় এবং হোঁচট খেয়ে থেমে যায়। এতে মার্কেট নষ্ট হয় এবং ব্যর্থ হওয়ায় হতাশ হয় এসব উদ্যোক্তারা। এ সমস্যা দূর করতে ই-কমার্স সম্পর্কিত লেখাপড়া বাড়াতে হবে।

রোখসানা আক্তার পপি বলেন, ফুলবাড়িয়া উপজেলার কাহালগাঁ গ্রামে অর্কিড চাষ হয়। সারাদেশে সৌখিন মানুষের চাহিদা মেটাতে ই-কমার্স সবচেয় বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে। গ্রামাঞ্চলের মানুষ ই-কমার্স সম্পর্কে অজ্ঞ। তাদেরকে ই-কমার্সে সম্পৃক্ত করতে প্রচারণার প্রয়োজন। আমাদের সিংহভাগ সম্ভাব্য কাস্টমার গ্রামে বাস করে তাই গ্রাম পর্যায়ে ডেলিভারি নিশ্চিত করতে পারলে দ্রুত বড় হবে ই-কমার্স খাত।

কুয়াশা কামরুন্নাহার বলেন, তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে বিদেশে রপ্তানি হয় জামালপুরের হস্ত পণ্য। এর ফলে শ্রমীকরা পর্যাপ্ত মজুরি না পেয়ে পেশা পরিবর্তন করতেছে। যদি সরাসরি ই-কমার্সের মাধ্যমে শতভাগ বিক্রি নিশ্চিত করা যায় তাহলে এসমস্যা থাকবে না। জামালপুরে প্রচুর বেনেনা ফাইভার এবং পাইনাপেল ফাইভার উৎপন্ন হয়। প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে এসব কাঁচামাল কাজে লাগানো যাবে এবং ই-কমার্সের মাধ্যমে সহজে বিক্রি করা যাবে।

আরিফা খাতুন বলেন, যেসব উদ্যোক্তারা শিখে মাঠে আসবে তারা দ্রুত এগিয়ে যাবে। যারা শেখার ক্ষেত্রে অলসতা করবে তারা জড়ে যাবে। ময়মনসিংহের উদ্যোক্তাদের ঐক্যতা ময়মনসিংহের ই-কমার্স ইন্ডাস্ট্রিকে বড় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কৃষি ও মৎস্য সেক্টরকে সম্ভাবনার চোখে দেখেন আরিফা খাতুন।