কানাডিয়ান লেখক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা নওমি ক্লেইন তার আলোচিত ‘দ্য শক ডকট্রিন; দ্য রাইজ অফ ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম’ বইতে উল্লেখ করেছেন, কোনো দেশে যদি প্রাকৃতিক কিংবা মানবসৃষ্ট কোনো দুর্যোগ হয়, তাহলে সেই সুযোগে সেখানে নানা অর্থনৈতিক তৎপরতা শুরু করা যায়। নানারকম অর্থনৈতিক তত্ত্বের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি নেওয়া যায় নানা প্রকল্প। নওমি ক্লেইনের মতে, এসব তত্ত্ব ও প্রকল্প হয়তো সাধারণ অবস্থায় মানুষ গ্রহণ করত না। এমনকি হয়তো তীব্র প্রতিবাদ করত। কিন্তু প্রচণ্ড বিপর্যয়ের মধ্যে থাকা মানুষ এগুলোকে খুব সহজে মেনে নেয়; এমনকি সমর্থন পর্যন্ত করে। এটাকেই নওমি বলছেন ‘ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম’ বা ‘বিপর্যয়কেন্দ্রিক পুঁজিবাদ’।
নওমি ক্লেইন দেখিয়েছেন কীভাবে পৃথিবীর সব বড় বড় ট্রানজিশন শক থেরাপির মাধ্যমে ঘটানো হয়েছে। ১৯৭০-এর দশকে দক্ষিণ আমেরিকার ইকোনমিক রিফর্ম থেকে শুরু করে পোল্যান্ড, চীন, দক্ষিণ আফ্রিকা, রাশিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া ও তাইওয়ানের অর্থনীতির রূপান্তরের ক্ষেত্রে শক থেরাপি কীভাবে কাজ করেছে, নওমি তার বইতে বিস্তারিত উল্লেখ করেছেন। এমনকি সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর রাশিয়ায় অলিগার্ক শ্রেণির উত্থানও হয়েছে এ বিপর্যয়কেন্দ্রিক পুঁজিবাদের মাধ্যমে। ঠিক একইভাবে গত দেড় দশকে বিপর্যয়কেন্দ্রিক পুঁজিবাদকে ব্যবহার করেই বাংলাদেশকে রাশিয়ার মতো একটি অলগার্কিক রাষ্ট্রে পরিণত করা হয়েছে। নওমি তার বইতে বিপর্যয়কেন্দ্রিক এ পুঁজিবাদের আলোচনায় একটি বিশেষ শক থেরাপির উল্লেখ করেছেন। এ লেখার একেবারে শেষদিকে সেই বিষয়ে আলোকপাত করব।
নওমির পর একজন অস্ট্রেলিয়ান-জার্মান অনুসন্ধানী সাংবাদিক ও লেখক অ্যান্টনি লোয়েন্সটেইন আফগানিস্তান, পাকিস্তান, হাইতি, পাপুয়া নিউগিনি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, গ্রিস, অস্ট্রেলিয়া ভ্রমণ করে বিপর্যয়কেন্দ্রিক পুঁজিবাদ প্রত্যক্ষ করেন এবং ২০১৫ সালে তার লেখা বিখ্যাত গ্রন্থ ‘ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম : মেকিং এ কিলিং আউট অব ক্যাটাসট্রফি’তে তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। তার দাবি অনুযায়ী, বিপর্যয়কেন্দ্রিক পুঁজিবাদ যতটা না প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে সৃষ্ট, তার চেয়ে অনেক বেশি ক্ষেত্রে মানবসৃষ্ট। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজমের বিপর্যয়গুলো মানবসৃষ্ট। আরও স্পষ্টভাবে বললে, রাষ্ট্র বা সরকারসৃষ্ট।
বাংলাদেশে গত দেড় দশকে নেওয়া অধিকাংশ অপ্রয়োজনীয় মেগা প্রকল্প শক থেরাপির মাধ্যমে জনগণকে গ্রহণ করানো হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানুষ এর প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা; কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বাগত জানিয়েছে। এর মধ্যে পদ্মা সেতুর রেল প্রকল্প, ঢাকায় ৫টি মেট্রোরেল প্রকল্প, একের পর এক ফ্লাইওভার উল্লেখযোগ্য। তবে এ লেখায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে বিপর্যয়কেন্দ্রিক পুঁজিবাদকে কীভাবে ব্যবহার করা হয়েছে, সেই বিষয়ে আলোচনা করব।
১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি দিক থেকে বিদ্যুতের চাহিদা ক্রমাগত বাড়তে থাকে। ভিন্নভাবে বললে বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতসহ শিল্প-কারখানার বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুতের চাহিদা ব্যাপকভাবে বাড়তে থাকে। ২০০১ সালে চারদলীয় জোট সরকার ক্রমাগত চাহিদা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। এতে দেশব্যাপী লোডশেডিং দুর্বিষহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। পোশাক খাতসহ শিল্প-কারখানার উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। চারদলীয় জোট সরকারের পর এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলেও পরিস্থিতির উন্নতি ঘটেনি।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। পরিস্থিতি যখন বেসামাল হয়ে পড়ল, তখন বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করতে সংসদে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ নামে একটা আইন পাশ করা হলো। অর্থাৎ বিদ্যুৎ খাতের সেই ইনডেমনিটি আইন। এ আইনের ৩ নং ধারা অনুযায়ী, কোনো ধরনের দরপত্র আহ্বান ছাড়াই কারও সঙ্গে আলোচনা করে চুক্তি করার ক্ষমতা নেয় সরকার। এর মধ্য দিয়ে সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত ‘পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ২০০৬’ অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতাকে পাশ কাটানোর ব্যবস্থা করা হয়। এমনকি ৯ ধারায় বলা হয় ‘এই আইনের অধীন কৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’ পাশাপাশি ১০ ধারায় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা কর্মচারীর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা বা অন্য কোনো ধরনের আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করার পথ বন্ধ করা হয়। শুরু হয় বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটের মহোৎসব।
এরপর একের পর এক ভাড়াভিত্তিক তরল জ্বালানিনির্ভর রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং অস্বাভাবিক উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তি করতে থাকে সরকার। উচ্চমূল্যের পাশাপাশি কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও বসিয়ে রেখে ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ) দেওয়ার শর্ত রাখা হয় এসব চুক্তিতে। কোনো বিদ্যুৎ উৎপাদন ছাড়াই হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারের ক্রনি এসব রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিকদের পকেটে চলে যায়। বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা চাহিদার দ্বিগুণ হওয়ার পরও এ রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করা হয়নি। বরং শুরুতে দুই বছরের জন্য চুক্তি করা হলেও দফায় দফায় মেয়াদ বৃদ্ধি করে ১৬ বছর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। এ চুক্তিগুলোর মধ্যে কিছু ক্ষেত্রে কেন্দ্রগুলোকে বৈদেশিক মুদ্রায় অর্থাৎ ডলারে মূল্য (বিদ্যুতের দাম এবং ক্যাপাসিটি চার্জ) পরিশোধের শর্ত রাখা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে ডলারের বিনিময় মূল্য অনুযায়ী, টাকায় পরিশোধের বিধান রাখা হয়েছে। ফলে একদিকে ডলারে পরিশোধের ক্ষেত্রে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ তৈরি হচ্ছে; অন্যদিকে ডলারের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ায় ডলারের বিনিময় মূল্য অনুযায়ী পরিশোধের ক্ষেত্রেও সরকারকে অনেক বেশি খরচ করতে হচ্ছে। গত ১৪ বছরে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের নামে সরকার ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা তার অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের পকেটে তুলে দিয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি কমানোর অজুহাতে গত ১৫ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার এবং খুচরা পর্যায়ে ১৩ বার বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী, বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকি কমাতে বছরে ৪ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। অথচ বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির প্রায় পুরোটাই চলে যাচ্ছে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে সরকারের অলিগার্কদের পকেটে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকির ৮১ শতাংশই ব্যয় হচ্ছে ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধে। অর্থাৎ সরকার তার অলিগার্কদের পকেটে তুলে দেওয়া হাজার হাজার কোটি টাকার বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে জনগণের ঘাড়ে। অথচ এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করার এখতিয়ার জনগণের নেই। সেই পথ ২০১০ সালের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের ইনডেমনিটি আইনের মাধ্যমে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং সেসময় বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিয়ে প্রচণ্ড শকে থাকায় আমরা সেটা মেনেও নিয়েছি।
জনগণের পকেট কাটার আরেক হাতিয়ার বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একজন গ্রাহকের প্রতি মাসে ডিমান্ড চার্জ এবং মিটার ভাড়া বহন করা। অথচ বিদ্যুতের মিটার একজন গ্রাহক নিজে কেনেন। নিজের কেনা মিটারের ভাড়া প্রতি মাসে সরকারকে দিতে হয়। বিষয়টি ঠিক ‘নিজের জমিতে নিজের খরচে বাড়ি করে ভাড়া দিয়ে থাকার মতো’। অথচ এর পরও বিদ্যুৎ খাতে সরকারের দেনা ৪৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। কাগজ-কলমে উৎপাদন সক্ষমতা ২৬ হাজার মেগাওয়াট ছাড়িয়ে গেলেও সর্বোচ্চ সাড়ে ১৬ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত উৎপাদন করতে পেরেছে সরকার। রিজার্ভ সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল, গ্যাস, কয়লা আমদানি করতে পারছে না সরকার। ফলে তরল জ্বালানিনির্ভর রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বেশির ভাগ সময়ই বন্ধ রাখা হয়। অথচ এরপরও দফায় দফায় এসব কেন্দ্রের মেয়াদ বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
নওমি ক্লেইন তার গ্রন্থে বিখ্যাত সাইকিয়াট্রিস্ট ইউইন ক্যামেরনের ৬০-এর দশকে করা একটি পরীক্ষার উল্লেখ করেছেন। পরবর্তী সময়ে এ পরীক্ষা বা তত্ত্বের সঙ্গে সিআইএ যুক্ত হয় এবং একটি ‘সাইকিয়াট্রিক শক থেরাপি’র উদ্ভব ঘটে। ক্যামেরনের তত্ত্ব অনুযায়ী, এ শক থেরাপির মাধ্যমে যে কোনো মানুষের মানসিক শক্তি পুরোপুরি ভেঙে দেওয়া যায় এবং এ থেরাপি (মানসিক অত্যাচার) প্রয়োগের পর একজন ব্যক্তি থেরাপি প্রয়োগকারীকে পূর্ণমাত্রায় সহযোগিতা করতে তৈরি থাকে। এ পর্যায়ে তাকে দিয়ে কোনো ধরনের প্রতিবাদ ছাড়াই যে কোনো কিছু করিয়ে নেওয়া যায়।
দেশের বিদ্যুৎ খাত ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজমের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বিদ্যুৎ খাতে লুটপাটকে জায়েজ করতে সরকার ইউইন ক্যামেরনের তত্ত্বই ব্যবহার করেছে। লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় বিপর্যস্ত জনগণ যখন এ অবস্থা থেকে মুক্তির জন্য যে কোনো কিছু মেনে নিতে তৈরি হয়েছে, ঠিক তখনই তাদের সামনে বিদ্যুৎ খাতে দায়মুক্তির কালো আইন নিয়ে আসা হয়েছে। তৈরি করা হয়েছে লুটপাটের আইনগত ভিত্তি।
সাকিব আনোয়ার : রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক