সুরাইয়া শারমিন
আলতাফ চেয়ারম্যানের বাড়ির উঠানে তিল পরিমাণ জায়গা নাই। মনে হচ্ছে গ্রামের সব মানুষ তার বাড়ির উঠানে এসে পড়েছে। গ্রামের মহিলারাও আছে, তবে তারা একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে আছেন। পুরুষ মানুষগুলো ঠেলাঠেলি করে কে কার সামনে গিয়ে দাঁড়াতে পারে সেই চেষ্টা করছেন। আজকের শালিসটা তাদের কাছে খুবই মজার এবং অন্য রকম আনন্দের মনে হচ্ছে।
আজকের সালিশ বসছে হাবা-গোবা বজলু আর তার বেশি চালক বউ ময়নাকে নিয়ে। ময়নাকে চালাক না বলে মুখরা বলাই ভালো। সে হলো দিনমজুর মতির মেয়ে। তার মাও সারাবছর চেয়ারম্যানের বাড়িতে ফুটফরমাশ খাটতেন। এই রকম পরিবারের মেয়েরা হবে সাত চড়ে, রা করে না টাইপ, আর ময়না হয়েছে এমন যে, তারে কেউ কিছু বললেই, ত্যাড়া টাইপ উওর দেয়। ময়না আবার গ্রামের ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ছে। ময়নার মা নিজে মানুষের বাসায় কাজ করলেও ময়নাকে কখনো কারো বাসায় কাজ করতে দেয় নাই।
ময়না দেখতে সুন্দর না হলেও, সে সব সময় পরিপাটি হয়ে থাকতো। আর বয়স কম বলে তার মধ্যে আলাদা একটা সৌন্দর্য ছিলো। তার দিকে অনেকের বদ নজর ছিলো। তবে কোন ছেলে তার সাথে কখনো, কোন রকম খারাপ মতলবে মিশতে পারে নাই। এর পেছনে সব চাইতে বড় অবদান ছিলো ময়নার মার। ময়নার মা সব সময় ময়নাকে বলতো,
-মাগো গরিব ঘরের মাইয়া মানুষের শরীররে সবাই মনে করে সরকারি জমিন, যে যেমনে পারে চড়ে বেড়াতে চায় সেখানে। ময়নার মার শরীরে মধ্যে সব সময় একটা তুষের আগুন জ্বলে, তার শরীরে কতজন যে হাত দিছে তার হিসাব নাই এই জীবনে।
সতেরো বছর বয়স হলে ময়নার মা ময়নাকে বিয়ে দেয় সেই গ্রামের হাবা বজলুর সাথে। বজলু ছেলেটা সহজ সরল আর খুবই কর্মঠ, সে কাজ করে চেয়ারম্যানের বড় ছেলের আড়তে।
আজ যেই ঘটনার বিচার বসছে চেয়ারম্যানের বাড়ির উঠানে। সেই ঘটনার শুরু ছিলো গতবছরের এক দুপুর বেলায়, সেই দিন দুপুরবেলা ময়না তার মার সাথে দেখা করতে চেয়ারম্যান বাড়িতে যাওয়ার সময়ে ঘটে সেই ঘটনা। চেয়ারম্যান বাড়িতে যাওয়া পথে একটা আম বাগান পার হতে হয়। আম বাগান পার হওয়ার আগেই এমন এক কাণ্ড হয় যে,তখন আর ময়নার চেয়ারম্যান বাড়িতে যেয়ে তার মায়ের সাথে দেখা করা হয় নাই।সে ফিরে চলে আসে তাদের বাড়িতে।
ময়নার চলে আসার কারণ ছিলো, তাকে একা আম বাগানে পেয়ে চেয়ারম্যানের বড় ছেলে তাকে জাপ্টে ধরেছিলো, তখন ময়না তার হাতে কামড়ে দিয়ে কোন রকমে দৌড় দেয়। তার পর মা বাড়িতে আসলে ময়না সব ঘটনা খুলে বলে তার মাকে। ময়নার মা তার পরেই ময়নাকে বিয়ে দিয়ে দেয় বজলুর সাথে।
বজলু আর ময়নার সংসার ছিলো সুখের। কারণ বজলু সব সময় ময়নার বুদ্ধি নিয়ে চলে আর ময়নাকে বলে আমার শিক্ষিত বউ। ময়নার আসলেই অনেক বুদ্ধি! ময়না বজলুর ছোট মাটির ঘরটাকে যত্ন করে টিপটপ করে রাখে। একটুখানি উঠান তাতে সবজি গাছ লাগিয়েছে। দুইটা মুরগী আর দুইটা হাস পালে, ঘরের ডিম খায় আবার ডিম বেচে, ঘরে বসে বেতের ঝুড়ি বানায়, পাইকার বাড়িতে এসে ঝুড়ি বানোর সব উপকরণ দিয়ে যায়। আবার হাটবারের আগের দিন এসে নিয়ে যায়।
সে যে মজুরি পায় তা জমাচ্ছে। তার স্বপ্ন সে এক সময় টাকা জমিয়ে একটা ছোট দোকান করে দিবে বজলুকে আর সে কখনো কারো বাড়িতে তার মায়ের মতো কাজ করবে না। আর বজলুকেও সারাজীবন অন্যের দোকানের কামলা খাটতে দিবে না। বজলু ময়নার মুখে যখন এই সব কথা শোনে তখন তার কলিজা বড় হয়ে উঠে, কি যে সুখ হয়! সেও ময়নাকে না জানিয়ে মাঝে মাঝে হাজি সাহেবের আড়তের মাল উঠিয়ে দিয়ে কিছু বাড়তি ইনকাম করা শুরু করেছে। তাই বড়ি ফিরতে দেরি হয় মাঝে মাঝে।
ঘটনার দিন রাতে বজলুর সাথে চেয়ারম্যানের বড় ছেলে পলাশ ভাইয়ের দেখা হয়। পলাশ ভাইজান যখন তাকে ছুটি দিয়েছিলো তখন মাগরিবের আজান হয় নাই। তারপর আবার যখন তার সাথে পলাশ ভাইজানের দেখে হয় তখন প্রায় রাত নেমে গেছে। পলাশ ভাইজান তাকে দেখে বলে,
– কিরে বজলু তুই এখনও বাড়িতে যাস নাই। তখন বজলু হাত কচলে তাকে বলে,
– সংসার হইছে তো মিয়া ভাই তাই একটু বারতি ইনকাম করা লাগে। হাজি সাবের গুদামঘরে মাল তুলনের কাম নিছি তাই বাড়ি যাইতে আজকা একটু দেরি হইবো।
এদিকে এই কথা শোনার সাথে সাথে চেয়ারম্যানের বড় ছেলের চোখ চকচক করে উঠে। তার মনে হয় এটাই সুযোগ ময়নার কামড়ের প্রতিশোধ নেওয়ার আর তার দেমাগ ভাঙ্গার। সে মনের আনন্দে বজলুর বাড়ি চলে আসে। এসে দেখে ময়না ঘরের ভেতরে বসে কুপির আলোয় কিছু বানাচ্ছে। সে আস্তে করে ঘরে ঢুকে পেছন থেকে ময়নাকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দেয় ময়না এক মুহূর্তের জন্য হতবিহ্বল হয়ে যায়! কি হলো বুঝতে পারে না! তখনও তার হাতে ধরা ছিলো বেত কাটার ধারালো ছুরিটা। ময়না শুধু একপলক দেখতে পায় চেয়ারম্যানের বড় ছেলের মুখটা। তার পর হাতের ধারালো ছুরিটা বসিয়ে দেয় তার চোখে। চোখ মানুষের এমন এক দুর্বল জায়গা যেখানে আঘাত পেলে আর ফিরতি আঘাত দেওয়ার ক্ষমতা থাকে না মানুষের।
তার পর চেয়ারম্যানের ছেলের চিৎকার শোনে গ্রামের মানুষ জড়ো হয় বজলুর বাড়ির উঠানে। আর এদিকে পলাশ শুধু চিৎকার করছে আর বলছে
– আমি মরে গেলাম, আমারে হাসপাতালে নিয়ে যান। গ্রামের লোকজন তাকে নিয়ে যখন চেয়ারম্যানের বাড়ির উঠানে আসে। ততক্ষণে পলাশ অজ্ঞান হয়ে গেছে। তার পর তাকে নিয়ে সদর হাসপাতালে গেলে, ডাক্তাররা তাকে দ্রুত ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যেতে বলে। তারপর শুরু হয় পলাশকে নিয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের ঢাকা মেডিক্যাল আর চক্ষু-হাসপাতালে দৌড়াদৌড়ি।
আর এদিকে গ্রামের ভেতরে আলোচনার ঝড় বইছে চেয়ারম্যানের বড় ছেলে কেন রাতে বেলা গিয়েছিলো বজলুর বাড়ি? রহস্য কি? আর তার চোখে চাকু ঢুকলো কেমন? আর ময়না তো কিছুই বলে না সেদিন কি হইছিলো? সেই ঘটনার পরে একমাস কেটে গেছে চেয়ারম্যানের ছেলের ডান চোখ চিরতরে অন্ধ হয়ে গেছে। আজ বিচার বসছে চেয়ারম্যানের বড়িতে, গ্রামবাসী জানতে চায়? পলাশ ভাইজানের চোখে ছুরি কি ময়না মেরেছে? আর কেন মেরেছে? থানার দারোগা সাহেবও এই বিচারে এসেছে?
ময়নাকে আসামি হিসাবে জেরা করা হচ্ছে, সেদিনের ঘটনা বলার জন্য। এদিকে চেয়ারম্যানের মনের মধ্যে আগুন জ্বলছে, তার ছেলের চোখের জন্য তার মনে হচ্ছে একটা শিক গরম করে ভরা মজলিসে ময়নার চোখে ঢুকিয়ে দিতে! কিন্তু থানার দারোগার সামনে তা করা অসম্ভব। এই দারোগা কম বয়সি আর কেমন জানি একটু অন্য রকম। সে লোক দিয়ে খবর পাঠিয়েছিলো এটা গ্রামের সালিশ, এখানে ওনার না থাকলেও চলবে। কিন্তু দারোগা শুধু নিজে আসে নাই, সাথে আরো তিন পুলিশ নিয়ে এসেছে। দারোগা ময়নার দিকে তাকিয়ে বলল, ময়না সেদিন রাতের ঘটনা খুলে বলো? তোমার কোন ভয় নাই। তখন ময়না বলা শুরু করলো,
– স্যার, সেদিন রাতে আমি প্রতিদিন রাতের মতো, আমার স্বামী বজলুর বাড়িতে আসার অপেক্ষায় ছিলাম। আর আমি সব সময়ই ঘরে বসে ঝুড়ি বানানোর কাজ করি, সেদিনও আমি ঝুড়ি বানাচ্ছিলাম। হঠাৎ করে কে জানি আমার পেছনে এসে দাঁড়ায়। আমি কুপির আলোয় তার ছায়া দেখতে পাই। আমি ঘুরে দেখতে চাই কে আসলো ঘরে। কোন আওয়াজ পাইলাম না! আমি তারে দেখার আগেই আমারে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় আর আমার গায়ের উপরে উঠে বসে।
– তখন আমি তারে আমার শরীর থেকে সরায়ে দিতে নেই। তখন আমার হাতে ছিলো বেত কাটার ছুরি, তা পলাশ ভাইজানের চোখে ঢুকে যায়। আমি তো ইচ্ছে করে ওনার চোখ কানা করি নাই। আর আমি তখন ভয়ে দিশা হারিয়ে ফেলেছিলাম।
– গতবছর আমাগো গ্রামের কলিম চাচার মাইয়ারে কারা জানি, ইজ্জত নিয়া তার পর গলা টিইপ্পা মাইরা রাইখ্যা গেছিলো একলা ঘরে পাইয়া। তার পর থাইকা আমি সব সময় দাও রাখি ঘরে, সেদিন আমার হাতে দাও থাকলে কি হইতো এইটা মনে হলে আমার কলিজা শুকায়ে আসে, আমিতো ভাইজানের কল্লা ফালাই দিতাম। ময়নার সাহসে সালিশে উপস্থিত সবাই অবাক হয়েে যায়!
পুলিশের দারোগার কাছে খবর ছিলো ময়নাকে আজকের সালিশের মধ্যে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়ে আছে। হয় ফতোয়া দিয়ে পাথর মারা হবে বা হঠাৎ করে গ্রামের লোক রাগ হয়ে ময়নাকে গণপিটুনি দিবে। তার জন্য চেয়ারম্যান লোক ঠিক করে রেখেছে। দারোগা সব কিছুর জন্য প্রস্তুতি নিয়ে এসেছে। সে এই শালিশের লোকজনের মধ্যে তার থানার কয়েকজন পুলিশকে সিভিল ড্রেসে মিশে থাকার নির্দেশ দিয়ে রেখেছে। কোন রকম সমস্যা দেখলেই একশনে চলে যাবে।
হঠাৎ করে ময়নার দিকে একটা ঢিল কেউ ছুঁড়ে দিলো। ময়নাকে বজলু আড়াল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাই ঠিক মতো ময়নার গায়ে লাগে নাই। এই বার দারোগা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় আর কঠিন গলায় বলে,
– আমার উপস্থিতির মধ্যে এত বড় সাহস কার সে সামনে এসে দাঁড়া, এইখানে লাশ ফেলে দিবো,পুলিশের উপস্থিতে আসামির গায়ে হাত দেওয়া আর পুলিশের গায়ে হাত দেওয়া একই বিষয়। আর এখনও ময়নার নামে কেউ থানায় মামলা করে নাই। দারোগা আস্তে করে চেয়ারম্যানকে বলে,
– এখানে মামলা হবে দুইটা। একটা হলো আপনার ছেলের নামে, সেটা করবে ময়না।
– মামলা করবে ধর্ষণের চেষ্টা করা এবং তাকে মাটিতে ফেলে আঘাত করার চেষ্টা নিয়ে, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে, যে মামলায় আসামিপক্ষ জামিন পাবে না।
আর একটা মামলা হবে, সেটা আপনি সাজান। কেন আপনার ছেলে হঠাৎ করে ময়নার ঘরে ঢুকে ময়নাকে জাপ্টে ধরেছিলো? আর ময়নার সাথে আপনার ছেলের কি শত্রুতা ছিলো যে, সে আপনার ছেলের চোখে ছুরি চালিয়ে দিলো! ভেবে চিন্তে মামলা সাজান।
তবে আমি আপনাকে বলে যাচ্ছি এখন থেকে ময়নার উপরে কেউ যদি হামলা করে, তবে আমি সোজা আপনার ছেলেকে জেলে ঢুকাবো। আর শক্ত কেস ফাইল করবো, সাক্ষীর অভাব হবে না, কারণ এই শালিসের সবাই জানে আপনার ছেলের চোখ কানা করে দিয়েছে ময়না। তাই ময়নার উপরে প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ময়নার উপরে পলাশ সাহেব ছাড়া আর কে হামলা করবে? বলেন? চেয়ারম্যান সাহেব হঠাৎ করে বুঝতে পারে, সে ময়নার সাথে লাগা মানে তার সাথে যুদ্ধ হবে এই দারোগার সাথে। তার নিজেকে অসহায় মনে হতে থাকে। এই দারেগাকে টাকায় কেনা যাবে না এর ধাচ সে বুঝে ফেলেছে। এই দারোগার ঘাড়ের রগ একটা ত্যাড়া।
লেখক : গল্পকার, লেখক ও উদ্যোক্তা, স্বত্বাধিকারী, অনলাইন প্লাটফর্ম ‘সুরাইয়া’।